ভাত ( গল্প ) মহাশ্বেতা দেবী - উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর

             ভাত 

                মহাশ্বেতা দেবী                     

     

১) বাস্তব জীবনের যথার্থ রূপকার হিসেবে মহাশ্বেতা দেবীর কৃতিত্ব ভাত গল্পের আলোকে বিচার করো ?


উঃ) সমাজের প্রান্তিক অবহেলিত মানুষদের জীবনের নিপুণ রূপকার মহাশ্বেতা দেবী । এই জীবন ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন — " আমি তাদের কাছে যাই , যাই  শুধু নয় , তারা আমার কাছে আছে , থাকে , তাও মাত্র নয় , তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত । " 


গল্পের ঘটনা ও চরিত্রগুলিও লেখিকার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ । পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের বিপন্নতার ছবি নিপুন তার সঙ্গে তিনি চিত্রিত করেছেন , তুলে ধরেছেন তাদের দুঃখ বেদনা অপমান লাঞ্ছনা , শোষণ বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা । উচ্চবর্ণ তথা উচ্চবিত্তদের বিপ্রতীপে সর্বহারা মানুষের জীবন পরম ক্ষমতায় তার এই ছোটগল্পে উপস্থাপিত হয়েছে । এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির রোষ ।  'উৎসব' চরিত্রটি সেই খামখেয়ালী প্রকৃতির অকারণ , প্রকৃতির অকারণ , চরম নঞথক । আচার সর্বস্ত্র মানবিকতাহিন উচ্চ আবৃত্ত ও উচ্চবর্ণের মানুষেরা তথাকথিত নিচু শ্রেণীর মানুষের প্রতি কি অপরিসীম ঘৃণার মনোভাব প্রকাশ করে , 

এমনকি প্রশাসন পর্যন্ত কিভাবে তাদেরই অঙ্গ লিহনে প্রভাবিত হয় গল্পে ফুটে উঠেছে সেই ছবি। আর এরই বিপরীতে সমাজ ও প্রকৃতির বীরু পাতায় পরজু দত্ত মানুষের তীব্র জীবন তৃষ্ণা ও অপরিমের প্রাণ শক্তির পরিচয় দীপ্ত তার কাহিনীর অবয়ব । একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে কাহিনীটি অবস্তিত হলেও এর আবেদনশত ও চিরকালীন ।


২) মহাশ্বেতা দেবীর  ভাত ছোট গল্প অবলম্বন করে ঝড় জল  বন্যা রাত্রিটির বর্ণনা দাও ?


উঃ) মহাশ্বেতা দেবীর ভাত ছোট গল্পে ঝড় জল বন্যার যে রাত উৎসবকে সর্বভ্রষ্ট করে দিয়েছিল , সেদিন সন্ধাতেই অনেক দিন পর সে স্বপরিবারে পেট পুরে খেয়েছিল । খেতে খেতে চন্দনীর মা বলেছিল যে , দেবতার গতিক ভালো নয় । নৌকা নিয়ে যারা বেরিয়েছিল , তাদের নৌকা শহর ডুবে মরে যাওয়ার আশঙ্কাও সে প্রকাশ করেছিল । এরপরই শুরু হয় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি । ঝড় বৃষ্টিতে উৎসবের কাঁচা বাড়ির মাছ খুঁটিটি  ' মাতাল আনন্দে টল ছিল ' ধনুষ্টকার রোগীর মত । তাই ঘরের মাঝখানের খুটিটা উৎসব মাটির দিকে সর্বশক্তিতে চেপে ধরেছিল কিন্তু তার মনে হচ্ছিল মা বসুন্ধরা জানো সেই খুঁটি রাখতে চাইছেন না , 

ছেলে বের করে দিতে চাইছেন । তাই ভয় ভগবানের নাম নিতে থাকে সে । অন্যদিকে ছেলেমেয়েকে জাপটে ধরে তার বউ ঠান্ডায় এবং ভয়ে কাঁপছিল। । এ সময় হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে উৎসব দেখতে পায় মাতাল মাতলা নদীর সফেন জল বাতাসের তোরে দ্রুত ছুটে আসছে। 

পরে একসময় জল নেবে গেলেও উৎসবের ঘরের সবকিছু এবং তার পরিবারকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই জল । বানের জলে ভেসে যাওয়া উৎসব গাছে বেঁধে অনুক্রমে প্রাণে বাঁচে । এইভাবে ঝড় জল জল বন্যার সেরা উৎসবের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল । 


৩) ঝর জল বন্যার রাতের আকস্মিক আঘাত উৎসবের মনোজগতে কি কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল , ভাত ছোট গল্প অবলম্বনে লেখ ? 


উঃ) মহাশ্বেতা দেবীর ভাত ছোটগল্পে ঝড় জল বন্যা রাত্রি উৎসবের ঘরের সব কিছু এবং তার পরিবারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও গাছে বেঁধে কোনক্রমে বেঁচে যায় সে । জল নেমে গেলে পরদিন সকাল থেকে উৎসব সবকিছু ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ আশায় কয়েকদিন উদগৃহীত হয়ে থাকে । 

ঘটনার আকস্মিকতায় সাময়িকভাবে উৎসবের বুদ্ধি লোপ পায় । ঘরের চালের নিচ থেকে প্রিয়জনদের ডাক শোনার আশায় সে আকুল হয়ে ওঠে । সবকিছু ফিরে পাওয়ার আশায় শুনশান বাড়ি ছেড়ে কয়েকদিন কোথাও না লড়াই তার কিছু খাওয়াও হয় না । এমনকি লঙ্গরখানায় দেওয়া খিচুড়ি ও নয় । তারপর যখন সে খানিকটা স্বাভাবিক হয় তখন খিচুড়ি দেওয়া বন্ধ করে সরকার শুকনো চাল দিতে থাকে ।

সেই চাল গুলি চিবিয়ে এসে কয়েকদিন কাটায় । টানা বেশ কিছুদিন ভাত না জোটায় সে ভাত খাবার জন্য পাগল হয়ে যায় কিন্তু তার জমিতে সে চাষ করে , সেই সতীশ বাবু গো তাকে ভাত দিতে অস্বীকার করলে সে অত্যন্ত দুঃখ পায় । ক্রোধ ও জন্ম নেয় তার মনে । সে মনে মনে বলে ওঠে , " তুমি কি বুঝবে সতীশবাবু ! নদীর পাড়েও থাক না । মেটে ঘরেও থাক না । 

দেশজোড়া দুর্যোগেও তোমার ঘরে রান্না হয় । সব হারানো উৎসবের উপর ঝুপড়ি উপোষের ফলে মানসিক বিকৃতি ঘটতে থাকে ‌। প্রায়ইছি তার মনে পড়ে সর্বনাশের রাতটার কথা । তার মনে হয় , দীর্ঘদিন ধরে পেটে ভাত না পড়ায় সে পেট হয়ে যাচ্ছে ভাত খেলে সে মানুষ হবে এবং তখনই সে বউ ও ছেলেমেয়ের দুঃখে কাঁদবে ‌‌‌‌।


৪) মায়ের সাথে দেবীর ভাত গল্প ছোট গল্পে উৎসবের চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর ? 


উঃ) মহাশ্বেতা দেবীর ভাত ছোটগল্পের উৎসব নাইয়া নিম্নবর্গীয় সমাজ ব্যবস্থার একজন প্রতিনিধি । ভাগ্যের ফেরে মাতলার বন্যায় বউ ছেলে মেয়েকে হারাই সে । ভেসে যায় তার মাথা গোজার আশ্রয়টুকুও । কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ উৎসবের জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নিলেও কেড়ে নিতে পারেনি তার আদিম প্রবৃত্তিকে , যে প্রবৃত্তির নাম খিদে ।   তাই প্রিয় জন হারানোর শোক কাটি ওঠার আগেই তার মধ্যে জেগে ওঠে ভাতের জন্য হাহাকার । 

হাভাতে উৎসবের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার আগে পর্যন্ত তার মধ্যেও ছিল কমলতার স্পর্শ। তাই সতীশ মিস্ত্রির তিন ধানে মোরক লাগলে ধানের প্রতি পরম মমতায় কেঁদে ভাসায় এই গরিব ভাগ চাষী । ভেসে যাওয়া ঘরের চালের নিচ থেকে পরিচিত সর্ষণার আশায় নাওয়া খাওয়া ভুলে বসে থাকে উৎসব , অসম্ভব জেনেও পাগলের মত বলতে থাকে ,  " রা কাম অচুন্নুনীর মা ! " 

পরম একাক্ষিত ভাতের স্পর্শে প্রেত উৎসবের ভেতর থেকে জেগে ওঠে মানুষ উৎসব । তাই বড় বাড়ি থেকে নিয়ে আসার ডেকচির ভাত খেতে খেতে সে মনে মনে সেই ভাত তুলে দেয় বউ ছেলে মেয়ের মুখে । "চন্দনী রে ! তুইও খা , চুন্নুনীর মা তুমিও খাও , ছোট খোকা খা আমার মধ্যে বসে তোরাও খা !" 

আসলে উৎসবের মতো বঞ্চিত , প্রান্তিক মানুষের সমাজ জীবনে ব্যক্তি নামেও কোনো মূল্য নেই । তাই আমরা দেখি তার নিরবসব জীবনে সে তারা উৎসব থাকে না ,  তার নাম পরিবর্তে হয়ে দাঁড়ায় উচ্ছব নাইয়া । 


৫) দাঁতগুলো বের করেছে কামোটের মতোই হিংস্র ভঙ্গি করে ।" — কে , কার প্রতি এরূপ আচরণ করেছিল ? তার এরূপ আচরণের কারণ বিশ্লেষণ কর  (২+3)


উঃ) মহাশ্বেতা দেবীর ভাত ছোট গল্পের মুখ্য চরিত্র উৎসব নাইয়া তার গ্রাম সম্পর্কিত বোন বাসিনির প্রতি এরকম আচরণ করেছিল । 

বুড়ো কর্তার মৃত্যুর পরে তার মৃতদেহ শ্মশানের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাবার পরে বড় পিসিমা নির্দেশ দেন বাড়ির সব রান্না ফেলে দিয়ে আসার জন্য । আর মুহূর্তের মধ্যেই মরিয়া উৎসবৃষ্টির করে নেয় সে কি করবে । সুন্দরবন থেকে শুধুমাত্র খাবারের সন্ধানে সে এসেছিল শহরের বড় বাড়িতে কাজ করতে । কিন্তু বুড়ো কর্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হোম যোগ্য শেষ না হলে খাওয়া হবে না— এই যুক্তিতে সে তার চরম আকাঙ্ক্ষিত খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল । 

এর মধ্যে এসে নানা রকম চালের এবং খাবারের গল্প শুনেছে ও দেখেছে । ফুটন্ত ভাতের গন্ধে সে উতলা হয়েছে কিন্তু ভাত জোটেনি তার । তাই বাসিনি ভাত ফেলতে গিয়ে লক্ষ্য স্থির উৎসব ভাতের বড় ডেকচি টা নিজেই নেয় এবং দূরে ফেলে দিয়ে আসার কথা বলে। । ডেকচি নিয়ে উৎসব দ্রুত হাঁটতে , তারপর দৌড়তে থাকে । কে বাদ আর ভাতের জন্য তার দীর্ঘসময়ের অপেক্ষা সেই ভাত এখন তার হাতের মুঠোয় হাতের মুঠোয় । 

এই সময় যখন বাসিনি তাকে সেই অসুজ বাড়ির ভাত খেতে নিষেধ করে , তা সহ করা কঠিন হয়ে পড়ে উৎসবের পক্ষে সে ফিরে দাঁড়ায় এবং কামোটের মতো হিংস্র চোখে বাসিনির দিকে তাকায় । তার দাঁত বের করা মুখভঙ্গি কামোটের মতোই হিংসো লাগে বাসি নির । 





2 Comments

Post a Comment

Post a Comment

Previous Post Next Post