১) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সভাপতি কে ছিলেন ? ওই কমিশনের রিপোর্টটি কত খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছে পেশ করা হয় ? ওই কমিশন উচ্চ শিক্ষার যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে , তা আলোচনা করো ।
অথবা , বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন 1948 – 49 খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে যে সুপারিশ করে , সেগুলি আলোচনা কর ।
উঃ) কমিশনের সভাপতি : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সভাপতি ছিলেন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন
কমিশনের রিপোর্ট পেশ : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছে তাদের রিপোর্টটি পেশ করে ।
উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে কমিশনের অভিমত : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে , সেগুলি হল —
১] বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ : বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে সমাজের নানান ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের উপযুক্ত ব্যক্তিদের গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে । দেশকে অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে হলে প্রয়োজন উপযুক্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের । আলোর দিশারী ওই সকল বুদ্ধিজীবীদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে ।
২] জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা : শিক্ষার মান উন্নয়নের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি কে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে , যাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা প্রাপ্ত প্রতিটি শিক্ষার্থী জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যোগ্য ধারক ও বাহক হয়ে উঠতে পারে ।
৩] জগৎ ও মানব জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার শিক্ষা : বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে শিক্ষার্থীদের সামনে সমগ্র জগৎ এবং মানব জীবন সম্পর্কে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে । শিক্ষার্থীদের মাঠ থেকে অবিশ্বাস এবং উদ্দেশ্যহীনতা দূর করে তাদের জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে ।
৪] গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা : গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য হলো ন্যায় বিচার , স্বাধীনতা , সাম্য এবং ঘ্রাতীত্ব । এই বিষয়গুলি মনে রেখে সকলে যাতে শিক্ষার সমান সুযোগ লাভ করে , ছাত্র-ছাত্রী , শিক্ষক শিক্ষিকাগণ যাতে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং অনুন্নত শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের চাহিদা যাতে পূর্ণ হয় , তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর সরকারি ।
কর্তৃত্ব ফলানোর প্রবণতা দূর হয়ে যাতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় — সে বিষয়েও সচেষ্ট হতে হবে ।
৫] মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধনের শিক্ষা : উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করা । এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে মানববিদ্যা চর্চার জন্য এমন ধরনের পাঠক্রম প্রণয়ন করতে হবে , যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতার বোধের বিকাশ তুরান্তিতো হয় ।
৬] মানব সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা গঠনের শিক্ষা : উচ্চশিক্ষার অপর একটি লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর মধ্যে মানব সভ্যতার সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তোলা । এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে আমার ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা মানব সভ্যতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত হতে পারে ।
৭] মানব চরিত্রের উন্নতি বিধানের শিক্ষা : যেকোনো শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো চরিত্র গঠন । শিক্ষার্থীরা যাতে চারিত্রিক উন্নতির জন্য বিশ্বসাহিত্যে লিপিবদ্ধ মানব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায় , তাদের মধ্যে যাতে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তারা যাতে মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে , তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ।
৮] জাতীয় সংহতি ও আন্তর্জাতিকতা বোধের শিক্ষা : উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হবে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে , মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তোলা । প্রাচীন ভারতীয় আদর্শ আবাসিক বিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে ।
এই সৌভ্রাতৃত্ববোধ বা জাতীয় সংহতি থেকে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ বা আন্তর্জাতিকতা বোধের বিকাশ ঘটবে । এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
৯] বিজ্ঞান , কারিগরিবিদ্যা , কৃষিবিদ্যা , ও চিকিৎসা বিদ্যার প্রসার ঘটানোর শিক্ষা : বিজ্ঞান , কারিগরিবিদ্যা , কৃষিবিদ্যা , ও চিকিৎসা বিদ্যার প্রসার ঘটানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে । বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার কল্যাণে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে ।
গ্রামের উন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে কৃষি বিদ্যা চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রসার ঘটাতে হবে।
১০] প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব শক্তির প্রকৃত সদব্যব্যবহারের শিক্ষা : ভারত প্রাকৃতিক সম্পদের যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী দেশ এবং ভারতবাসীদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা ও কর্মশক্তি রয়েছে । তাই বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে এমনভাবে শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে , যাতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব শক্তির প্রকৃত সদব্যব্যবহারের করা যেতে পারে ।
২) শিক্ষাদানের মানোন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ গুলি আলোচনা করো ।
উঃ) শিক্ষাদানের মনোনয়ন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ : কভিশন উপলব্ধি করেছিল কেবল প্রতিভাবান শিক্ষক নিয়োগ করলেই চলবে না , বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সঠিক সংস্কারের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মানোন্নয়ন করতে হবে ।
এর জন্য কমিশন কতগুলি সুপারিশ লিপিবদ্ধ করে । সেগুলি হল —
১] বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারমিডিয়েট স্তর বিলোপ : বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারমিডিয়েট স্তরটির বিলোপ ঘটিয়ে , সেটিকে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা ক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে । শিক্ষার্থীরা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২ বছরের শিক্ষাক্রম শেষ করলে তবেই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রবেশের ছাড়পত্র পাবে ।
২] ইন্টারমিডিয়েট মহাবিদ্যালয় স্থাপন : প্রতিটি রাজ্যে অধিক সংখ্যক উন্নত মানের ইন্টারমিডিয়েট মহাবিদ্যালয় স্থাপনের জন্য কমিশন অভিমত ব্যক্ত করে । কমিশনের মতে , নবনির্মিত ইন্টারমিডিয়েট মহাবিদ্যালয় গুলিতে নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত অথবা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা থাকবে ।
৩] বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা : সাধারণ ধর্মে শিক্ষার পাশাপাশি কমিশন সারাদেশে বহু সংখ্যক বৃত্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুপারিশ করে । শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণী বা দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ শেষ করে ওইসব বৃত্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে জাতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় , তার জন্য পরিকাঠামো উন্নয়নের সুপারিশও করা হয় ।
৪] রিফ্রেসার কোর্স প্রবর্তন : যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা উচ্চ বিদ্যালয় বা ইন্টারমিডিয়েট মহাবিদ্যালয় পাঠদানে নিযুক্ত থাকবেন , তাদের শিক্ষাগত যোজ্যতা সময়োপযোগী করে তোলার জন্য কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে রিফ্রেসার কোর্স ( Refresher Course ) প্রবর্তনের জন্য মূল্যবান সুপারিশ করে ।
৫] শিক্ষার্থীসংখ্যা নির্ধারণ : কবে জন্মাবিদ্যালয় সর্বোচ্চ ১৫০০ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ ৩০০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুপারিশ করেন ।
৬] কর্ম দিবস নির্ধারণ : কমিশনের মতে , মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিখন- শিক্ষণ দিবস হবে বছরে কমপক্ষে ১৮০ দিন ।
পরীক্ষা ও অন্যান্য কর্মসূচির দিনগুলি এই সংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না । প্রতিটি শিক্ষাবর্ষকে তিনটি পর্যায় ( Term ) ভাগ করা হবে । প্রত্যেক পর্যায়ের স্থিতিকাল হবে ১১ সপ্তাহ ।
৭] মনোগ্রাহী পাঠদান : মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কৌশলকে শিক্ষার্থীদের কাছে মানোগ্রাহী করে তুলবার জন্য কমিশন টিউটোরিয়াল ক্লাস , লিখন অনুশীলন , গ্রন্থাগারের কাজ প্রভৃতির সহায়তা গ্রহণের সুপারিশ করে ।
পাস ও অনার্স কোর্সের শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক টিউটোরিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮] গ্রন্থাগার গুলির উন্নতি বিধান করা : মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিক্ষিকারা যাতে অবাধে প্রবেশ করতে পারে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে । উপযুক্ত যোজ্যতা সম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রন্থাগার কর্মী নিয়োগ করতে হবে ।
৯] বীক্ষনাগারের উন্নয়ন : যেসব বিষয়ে তত্ত্বগত জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় , সেই সমস্ত বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বৃক্ষনাগারের উন্নয়ন ঘটাতে হবে । এর জন্য কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে ।
১০] অন্যান্য সুপারিশ :
১) কমিশনের মতে , বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্ধারিত কোন কোর্সের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক থাকবে না । শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পুস্তক অধ্যায়নের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করবে ।
২) শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষে নিয়োমিত হাজির থাকা বাধ্যতামূলক হবে ।
৩) কেবল প্রাইভেট শিক্ষার্থীরা মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ পরীক্ষা( Public Exgamination ) দানের সুযোগ লাভ করবে ।
৪) যারা কোন সংস্থা চাকুরীরত , তাদের জন্য পরীক্ষা মূলকভাবে সান্ধাকালীন মহাবিদ্যালয় খোলা যেতে পারে ।
إرسال تعليق